নিউট্রিশন

তরমুজের উপকারিতা অপকারিতা ও তরমুজ চাষ পদ্ধতি

তরমুজ একটি গ্রীষ্মকালীন ফল। গরমের দিনে আদ্রতায় শরীর থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়। এই পানিশূন্যতা দূর করতে তরমুজ হতে পারে একটি আদর্শ ফল। বিশেষ করে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন রমজান মাসে তরমুজ এবং বাংগী ছাড়া ইফতার কল্পনাই করা যায়না।  তরমুজের ইংরেজী- (Watermelon) এবং তরমুজের বৈজ্ঞানিক নামঃ (Citrullus lanatus) । তরমুজ মিষ্টি ও রসালো ফল। এর আকৃতি গোলাকার বাইরে সবুজ খোসা এবং ভিতরে উজ্জ্বল লাল রংয়ের। তরমুজ মূলত বালি প্রধান এলাকায় বেশি জন্মে। 

এই নিবন্ধে তরমুজের উপকারিতা, অপকারিতা ও এর চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

তরমুজ
ছবি – তরমুজ

 

তরমুজের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা 

১.তরমুজে থাকা পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এক গ্লাস তরমুজের রস পান করলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

২.তরমুজে থাকা প্রচুর পরিমাণ পানি ডিহাইড্রেশন দূর করে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে। এতে চর্বি থাকেনা। সিট্রুলাইন নামক উপাদান  ওজন কমাতে সাহায্য করে।

৩. তরমুজ শরীরে শক্তির পরিমাণ বাড়িয়ে কাজ সম্পাদন করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ  শক্তি প্রদান করে।

৪.তরমুজ কোলেস্টেরলের মাত্রা হূদরোগ নিয়ন্ত্রণ করে  ও হার্ট কে শক্তিশালী করে।

৫.তরমুজে আছে ভিটামিন সি যা  শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধ করে হাঁপানি থেকে রক্ষা করে।

৬.তরমুজে থাকা প্রচুর পরিমাণ পানি শরীর থেকে টক্সিন দূর করে কিডনিকে সুস্থ রাখে। নিয়মিত তরমুজ খেলে কিডনি পাথর মুক্ত থাকে।

৭.তরমুজের” ভিটামিন এ” চোখের রাতকানা ছানি ও বয়স জনিত সমস্যা রক্ষা করে।

৮.তরমুজ খাওয়ার পর শরীর  শীতল হয় ও গরমের দিনে মাথা ব্যাথা কমায়।

৯.তরমুজ শরীরে হরমোনের মাত্রা  স্বাভাবিক রাখে ও মানসিক প্রশান্তি আনয়ন করে।

১০.তরমুজের রস টেস্টোস্টরেন হরমোনের পরিমাণ বাড়িয়ে যৌন আগ্রহ বাড়ায়।

১১.তরমুজে থাকা  ক্যারোটিন ও ক্যালসিয়াম উপাদানটি  হাড় মজবুত করে।বৃদ্ধ বয়সে এর সুফল পাওয়া যায়।
১২.শরীরচর্চার পর পেশিতে ব্যথা অনুভব হলে প্রতিদিন শরীর চর্চার আগে  এক কাপ তরমুজের রস পেশী ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

১৩.তরমুজের থাকা ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদান প্রস্টেট ক্যান্সার রোধে সহায়ক।

 

তরমুজের অপকারিতা 

*তরমুজ গ্রহণের পর  শরীরে ১৫০ গ্রামের বেশি ক্যালরি বেশি হলে তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর হয়।

*তরমুজে থাকা অতিরিক্ত পানি কিডনির সমস্যা সৃষ্টি করে।

*তরমুজে প্রচুর পরিমাণ শর্করা থাকার কারণে নিয়মিত তরমুজ গ্রহণ করলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়তে পারে।

*বেশি পরিমাণে তরমুজ গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস রোগী ও গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

*তরমুজের  থাকা লাইকোপিক নামক অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদানটি প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করলে  ডায়রিয়া,বদহজম, গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।

 

তরমুজ চাষ পদ্ধতি

 

বাজারে তরমুজের চাহিদা হওয়ার কারণে কৃষকরা তরমুজ চাষে বেশ আগ্রহী। তরমুজ চাষে প্রয়োজন সূর্যের আলো ও শুষ্ক আবহাওয়া।তরমুজ চাষের জন্য উর্বর দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি খুবই উপযোগী। বাংলাদেশেরর তরমুজ চাষের উপযুক্ত সময় হলো ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বীজ বুনতে হয়।

কিছু হাইব্রিড তরমুজের বীজ জাতসমূহ হলো 

>টপইল্ড, গ্লোরি,সুগার বেবি,বেবি তরমুজ (বারমাসি)
>ভিক্টার সুপার F1,ওসেন সুগার F1,বঙ্গ লিংক F1,গ্রীন ড্রাগন (নভেম্বর -ডিসেম্বর)
>সুপার এম্পেরর,আনারকলি,চ্যাম্পিয়ন, ব্ল্যাক ডায়মন্ড, ব্যাক সান (ভাদ্র -মাঘ)

১.তরমুজ চাষ করার জন্য প্রথমেই এর জমি তৈরি করে নিতে হয়। প্রয়োজনমতো চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরীর পর মাদা প্রস্তুত করতে হয় এবং তাতে সার প্রয়োগ করে চারা লাগানো যায়। বীজ সরাসরি মাদায় বপন করতে হয়। প্রতিটি মাদায় পাঁচটি বীজ বপন করতে হয় এবং বীজ বপনের ৮ থেকে ১০ দিন আগে ২ মিটার দূরত্ব অনুযায়ী সারি করে  মাদা তৈরি করে নিতে হয়। প্রতিটি মাদা ৫০সেমি প্রশস্ত এবং ৩০ সেমি গভীর হতে হবে।

তরমুজের চারা রোপণ করতে চাইলে ছোট ছোট পলিথিন ব্যাগে বালি ও পচা গোবর ভর্তি করে বয়সের ৫ থেকে ৬ টি পাতা একটি চারা  মাদায় রোপণ করা হয় ।

২.সাধারণত প্রতি হেক্টরে ৮৫০ গ্রাম থেকে ১০০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।

৩.তরমুজ চাষে চার বার জমিতে সার প্রয়োগ করা হয়।প্রথমবার সার দেওয়া হয়  চারা রোপণ করা ১০ থেকে ১৫ দিন পর,দ্বিতীয় বার  প্রথম ফুল ফোটার পর এবং তৃতীয় বার ফল ধারণের সময়  ও  সর্বশেষ  সার দেওয়া হয় ফল ধারণের ১৫ থেকে ২০ দিন পর।
তরমুজ চাষে যেসকল সার ব্যবহার হয় তার তালিকাঃ

*গোবর সার আট টন
* টিএসপি ৪০ কেজি
*জিংক সালফেট ৫ কেজি *ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৯ থেকে ১০ কেজি
*সালফার তিন কেজি
*ফিপ্রোনিল জাতীয় দানাদার ১০ থেকে ১২ কেজি
*ইউরিয়া সার ২৫ থেকে ৪০ কেজি

৪. তরমুজ চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো বীজের অঙ্কুরোদগম। শীতকালে ঠাণ্ডা অবস্থায় বীজকে ১২ ঘন্টা জলে রেখে গোবরের মাদার ভেতরে থাকা বালির মধ্যে রেখে দিলে তাড়াতাড়ি বীজ অঙ্কুরোদগম হবে।এবং ৩-৪ দিন সময় নিবে।বীজ অঙ্কুর দেখা দিলে বীজকে বীজ তলায় মধ্যে স্থানান্তরিত করতে হবে।

৫.শুষ্ক মৌসুমে সেচ দিতে হবে । এক্ষেত্রে গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রতিটি গাছে ৩-৪টি বেশি ফল রাখা যাবে না।লক্ষ্য রাখতে হবে,  ত্রিশটি পাতার জন্য মাত্র একটি ফল রাখা উচিত। অতিরিক্ত শাখাগুলো ছাটাই করে দিতে হবে।

৬. তরমুজ চাষে সবচেয়ে বড় শত্রু হলো পোকা। পাতার বিটল পোকা,জাব পোকা, কাটুই পোকা, ফল ছিত্রকারী পোকা,লাল মাকড়, থ্রিপস ইত্যাদি পোকার দ্বারা তরমুজের ক্ষতি হতে পারে।এসব পোকা রাতের বেলা চারার ক্ষতি করে।এসব পোকা দমন করার জন্য কেরোসিন মিশ্রিত পানি দিতে হবে।এছাড়া  রিজেন্ট ৫০ এসসি,হেক্লেম ৫ এসজি,  মিথাইল আইসোপ্রোকার্ব, নোভাস্টার ৫৬ ইসি ইত্যাদি পানিতে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।

তরমুজের গাছের গোড়ার কান্ড পঁচা রোগ দেখা দিলে কোগার ২৮ এসসি স্প্রে করতে হবে।ফিউজেরিয়াম উইল্ট রোগের আক্রমণে গাছ ঢলে পড়লে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে আর আক্রান্ত গাছ উপড়ে ফেলতে হবে।

৬.বীজ বপন করার তিন থেকে চার মাস পর ফল সংগ্রহ করতে হয়। এটি সাধারণত আবহাওয়ার ও জাতের উপর নির্ভর করে। ফল পাকলে বোটা শুকিয়ে বাদামী রং ধারণ করে।তরমুজের খোসার ওপর শুকনো লোম মরে গিয়ে খোসা চকচক দেখায়  আর আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিলে ড্যাবড্যাব শব্দ হয় যা থেকে ফলের পরিপক্কতায় নির্ণয় করা যায়। ওই অবস্থায় তরমুজ সংগ্রহ করতে হবে।

সঠিক ভাবে চাষ করলে প্রতি একরে ৪০-৫০ টন তরমুজের ফলন পাওয়া যাবে।

তরমুজ ফলের বহুমুখী উপকারীতার জন্য সকলে এই ফল চাষ করে উপকৃত হবে।তরমুজ ফল গ্রহণের সময় পরিমাণ মাফিকভাবে গ্রহণ করতে হবে ও এর ক্ষতিকর দিক গুলো মেনে চলতে হবে।