মধুর অবিশ্বাস্য উপকারিতা-অপকারিতা ও মধু খাওয়ার নিয়ম
মধু খাওয়ার উপকারিতা ও মধু সেবনের কিছু ক্ষতিকর দিক
মধু হল একটি মিষ্টি তরল যা মৌমাছিরা ফুল থেকে আহরন করে। মধুতে মুলত থাকে চিনি এবং আরো থাকে অ্যামিনো এসিড, ভিটামিন, মিনারেল, আয়রন, জিঙ্ক এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।মধুর যেমন রয়েছে স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারি দিক ঠিক তেমনি ভাবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার স্বাস্থ্যে ফেলতে পারে বিরুপ প্রভাব। মধু আপনার জন্য কী করতে পারে সে সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা পেতে মধুর উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
উপকারিতাঃ
শক্তি প্রদানঃ
মধু শক্তির একটি গুরুত্ব পূর্ণ উৎস্য। মধুতে আছে প্রচুর পরিমান শকর্রা যা দেহে শক্তি যোগায় এবং কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ
শরীরে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারে মধু। কারণ মধুতে আছে প্রচুর পরিমাণে মিনারেল, ভিটামিন ও এনজাইম যা শরীরকে বিভিন্ন অসুখ বিসুখ থেকে রক্ষা করে।
ক্ষত নিরাময়ঃ
মানুষ হাজার বছর ধরে ক্ষত নিরাময়ে মধুর ব্যবহার করে আসছে। মধুর রয়েছে কিছু জৈব সক্রিয় উপাদান যা ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করে থাকে। মধুতে থাকা ডিফেনসিন-১ প্রোটিন ক্ষত নিরাময়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
পোড়াস্থান নিরাময়ঃ
মধু একটি আর্দ্র পরিবেশ প্রদান করেl যা পুড়ে যাওয়া স্হানে স্বস্তি প্রদান করে, রোগ জীবাণু প্রতিরোধ করে এবং দ্রুত নিরাময়ে সহায়তা করে।
সর্দি এবং কাশি উপসর্গ উপশমঃ
শীতকাল যদি আপনার গলা ব্যথা এবং কাশি নিয়ে আসে তবে এক চামচ মধু হতে পারে আপনার জন্য বেশ প্রশান্তিদায়ক। মধু স্বাভাবিকভাবে কাশি ও গলা ব্যথা উপশমে সাহায্য করে। গবেষকরা বলেছেন মধু কাশি এবং গলা ব্যথা উপশমে খুবই কার্যকরী। এটি গলাকে প্রশমিত করতে এবং রক্ষা করতে এক ধরণের বাধা তৈরি করে।গাঢ় মধু সবচেয়ে ভালো, কারণ তাদের ব্যাকটেরিয়ারোধী গুণাবলী সাধারণত হালকা মধুর চেয়ে বেশি – এবং তারা দুর্বল গলা এবং বুকের এলাকায় সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণকে নিরুৎসাহিত করতে সাহায্য করে। এই কারনেই যারা কাশিতে ভুগছে তাদের জন্য এটি বেশ উপকারি।দুই টেবিল চামচ মধু এক কাপ ঈষদুষ্ণ পানির সাথে আপনার আটকে থাকা নাকের পথ পরিষ্কার করতে সাহায্য করে মধু।
ওজন হ্রাসঃ
মধু দেহের চর্বি কমাতে সাহায্য করে এবং বিপাকিয় শক্তির হার বাড়ায়। ফলে দেহের অতিরিক্ত চর্বি কমে এবং ওজন হ্রাস হয়।প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মধু ও লেবু মিশিয়ে খেলে এক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়া যায়
ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি : মধু ত্বকের মসৃণতা, উজ্জ্বলতা ও কোমলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। তাই মধু মেয়েদের রূপচর্চায় খুবই জনপ্রিয়।মধুতে উপস্থিত জাইলোজ,সুক্রোজ ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে বাধা দেয় ফলে মুখে ব্রণ উঠা প্রতিরোধ করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণ : মধুতে আছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স যা পরিপাক্তন্ত্রকে উন্নত করে।খাবার হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যতা দূর করে।
হৃদরোগে ভূমিকা : মধু হৃদপিন্ডের পেশিকে সবল করে এর কাজ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে । ফলে হৃদপিন্ডের কার্যক্ষমতা বাড়ে যা বিভিন্ন হৃদরোগের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
রক্ত উৎপাদন : মধুতে আছে আয়রন। আয়রন আমাদের শরীরে রক্ত উৎপাদনের মূল উপাদান। অথার্ৎ মধু রক্ত উৎ পাদনে সহায়তা করে থাকে। এছাড়া আনার এবং ড্রাগনফলও আপনার রক্ত উতপাদনে খুবই উপকারী
দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি: মধু চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।মধুর সাথে গাজর খেলে চোখের দৃষ্টি ক্ষমতা বাড়ে।
হাড় ও দাঁতের গঠন : মধুতে রয়েছে ক্যালসিয়াম। ক্যালসিয়াম আমাদের হাড় ও দাতঁ গঠনের মূল উপাদান।
তারুণ্যতা রক্ষা : মধুতে রয়েছে প্রচুর পরিমান অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ত্বকের টান টান ভাব ধরে রাখে, কোমলতা প্রদান করে , মুখে ছাপ দূর করে। ফলে তারুণ্যতা বজায় থাকে। এছাড়া ত্বকের যত্নে ঘৃতকুমারী ব্যাবহার করতে পারেন।
ঘুমের সমস্যা দূরীকরণ : মধু মেলাটোনিন গঠনকে উৎসাহিত করতে পারে যা ঘুমের সূচনা করতে সহায়তা করে এবং সেইসাথে হরমোন নিঃসরণকে উৎসাহিত করে যা ঘুমের সময় পুরো শরীর পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে। তাই রাতে ঘুমানোর আগে ১চামচ মধু খেলে ভালো ঘুম হয়।
প্রদাহ প্রতিরোধ : মধুতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরকে প্রদাহ থেকে রক্ষা করতে পারে। প্রদাহ হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং অটোইমিউন ডিসঅর্ডার সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে।
খাবারে ফ্লেভারিং : মধু চিনির বিকল্প স্বাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি কেক, কুকিজ, মাফিন, বিস্কুট এবং রুটির মিশ্রণের মতো বেকিং পণ্যগুলিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি মিষ্টান্ন সামগ্রী, পানীয়তে যোগ করা যেতে পারে এবং সিরিয়াল, প্যানকেক এবং ফ্রেঞ্চ টোস্টের উপর ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে ফলে মধুর মিষ্টি সুগন্ধে খাবারের রুচি আরো বৃদ্ধি পায়।
স্নায়বিক রোগ নিরাময় : বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে মধু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টিকনভালসেন্ট এবং অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি সুবিধা দিতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা যায় , মধু স্মৃতিশক্তির ব্যাধি প্রতিরোধে সাহায্য করে।
পায়ের আলসার নিরাময় : মধু ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত পায়ের আলসারের জন্য একটি কার্যকর চিকিৎসা, যা গুরুতর জটিলতা যা অঙ্গচ্ছেদ হতে পারে।
শ্বাসনালী সংক্রমন রোধ: মধু শ্বাসনালী সংক্রমন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ও সহায়ক। মধু ফুসফুসের মধ্যে শ্বাসনালী প্রদাহ কমাতে পারে এবং শ্লেষ্মা ভাঙতে সাহায্য করতে পারে যা আপনার শ্বাস নেওয়া কঠিন করে তোলে। ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের উপরের শ্বাসনালীর সংক্রমণে ঘুমানোর সময় ২ চা চামচ (১০ মিলিলিটার) পর্যন্ত মধু দেওয়া হয়।
ঔষধি ব্যবহার:আয়ুর্বেদিক ঔষুধে, মধু চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়।বিভিন্ন অসুস্থতা, আঘাতে অন্যান্য প্রতিকারের সাথে মিশিয়ে মধু ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও রক্তশুন্যতা, অনিদ্রা, অরুচি, যৌন দূর্বলতা,উচ্চ রক্তচাপ, হাপানি নিরাময়ে ও মধু গুরুত্তপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মধু খাওয়ার নিয়ম
বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে মধুর সম্পুর্ন উপকারিতা পেতে অনুসরন করতে হবে মধু খাওয়ার সঠিক নিয়ম। ভুল নিয়মে মধু সেবন করলে মধুর পুষ্টির পরিবর্তে অপকারিতা জুটতে পারে আপনার ভাগ্যে তাই চলুন জেনে নেয়া যাক কিছু কমন সমস্যায় কি নিয়মে মধু সেবন কবেন।
- মধুর ভাল উপকারিতা পেতে মধু খাওয়ার সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে খালি পেটে মধু খাওয়া
- মধু মিশ্রিত দুধ খেতে চাইলে অবশ্যই দুধ ঠান্ডা রুম টেম্পারেচারে করে মধু মেশাবেন।
- রান্না করে বা কোন গরম খাবারে মধু মিশ্রিত করবেন না।
- একটু পুরাতন মধু নতুন আহরিত মধুর তুলনায় বেশি উপকারি
- বমি বন্ধ করতে মধুর সাথে একটু গুড় মিশিয়ে সেবন করুন
শর্দি-কাশিও ক্ষুধামন্দায় মধু খাওয়ার নিয়মঃ
এক চা চামচ মধুর সাথে এক চা চামচ আদার রস মিশিয়ে দুই বেলা খেলে শর্দির সমস্যায় উপকার পাবেন। ক্ষুধা মন্দা দূর করতেও এই পদ্ধতি কার্যকরী। এছাড়া কাশি দূর করতে বাসক পাতার রসের সাথে মিশিয়ে মধু সেবন করুন। তুলসী গাছের পাতার রসও মধুর সাথে সমপরিমাণে মিশিয়ে খেলে সর্দি দূরে পালায়। আপনি জানেন কি সর্দি জ্বর কেন হয়?
এসিডিটি দূর করতে মধু সেবনের নিয়মঃ
এসিডিটি দূর করতে মধু সেবনের সঠিক নিয়ম জানেন কি? কাঁচা মধুর সাথে লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়াই হচ্ছে এসিডইটির সমস্যায় মধু খাওয়ার সঠিক উপায়। হজমের সমস্যা সমাধানে খাবারের আগে এক চামচ মধু ঔষধের মতো কাজে দেয়।
ওজন কমাতে মধু যে নিয়মে খাবেনঃ
ওজন কমাতে আমরা কত কিছুই না করে থাকি, কিন্তু বেশি খেয়েও কিভাবে ওজন কম রাখা যায় জানতে এই পোস্টটি পড়ে আসুন। মধুর সাথে লেবুর রস মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে লেমন ওয়াটার উইথ হানি পান করুন। ওজন কমবে এবং লিভারও পরিষ্কার হবে।
যৌন দুর্বলতায় মধু খাওয়ার সঠিক পদ্ধতিঃ
ছোলার সাথে মধু মিশিয়ে খেলে যৌন দুর্বলতা দূর হয়। রাতে দুধের সাথে মধু খেলে শক্তি বৃদ্ধি পাবে। রাতে দুধের সাথে মধু খাওয়ার সঠিক নিয়ম হলো স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থাকা এক গ্লাস দুধের সাথে একটি কলা এবং এক বা দেড় চামচ মধু ব্লেন্ড করে মিশিয়ে খেয়ে নিন। এই সমস্যায় সমাধান পেতে রসুন খেলেও উপকার পাবেন।
ইসলামে মধু খাওয়ার নিয়মঃ
ইসলামে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরানে যে কয়েকটি খাবারকে মহামান্বিত করা হয়েছে এর মধ্যে দুধ , খেজুর ,ত্বিনফল, মধু অন্যতম । মধুকে আল্লাহ্ প্রদত্ত পথ্য গুলোর একটি হিসেবে গন্য হয় । নবী করিম মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে সকালে মধু সেবন করেছেন এবং তার অনুসারীদেরও বলেছেন নিরোগদেহ পেতে মাসে অন্তত তিন দিন ভোরে মধু সেবন করতে।
অপকারিতা :
মধুর অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের দেহের স্বাভাবিক কাজ কর্মের বাধা হয়ে দাড়াতে পারে।যেহেতু এটি প্রাকৃতিক শর্করা সেহেতু এর ব্যবহার নূন্যতম রাখাই শ্রেয়। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এক গবেষনায় জানিয়েছেন যে পুরুষরা প্রতিদিন নয় চা চামচ (৩৬ গ্রাম) এর বেশি খাবেন না; মহিলা এবং শিশু, প্রতিদিন ছয় চা চামচ ( ২৪ গ্রাম) এর বেশি নয়।
রক্তে চিনির পরিমান বৃদ্ধি : মধু হলো চিনির ই একটি বিকল্প । কিন্তু এতে রয়েছে প্রাকৃতিক শর্করা যা রক্তে শর্করার পরিমান বাড়িয়ে দেয়। এটি পরবর্তীতে টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগের উৎপত্তি ঘটায়।
মধু চিনি থেকেও বেশি মিষ্টি। মধু ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ক্ষতিকর ও বটে। তাই ডায়াবেটিক রোগীদের উচিত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মধু গ্রহন করা এবং অতিরক্ত মধু খাওয়া থেকে বিরত থাকা।
রক্তচাপ বৃদ্ধি : মধুতে থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে কিন্তু অতিরিক্ত পরিমান মধু রক্তচাপ বাড়িয়ে হাইপারটেনশন ঘটাতে পারে।
মাড়ির ক্ষতি : অতিরিক্ত মধু মাড়ির ক্ষতি করতে পারে। ফলে মাড়ি নরম ও ফুলে যায়।
পরাগ এলার্জি:
পরাগ এলার্জি খড় জ্বর নামেও পরিচিত। মধু পরাগ থেকে তৈরি এবং এলার্জি হতে পারে। ফুলের পরাগ থেকে যাদের এলার্জি তাদের উচিত মধু পরিহার করা।
শিশুদের ক্ষেত্রে: কমপক্ষে এক বছর বয়সী শিশুদের মুখে মুখে খাওয়ার সময় মধু সম্ভবত নিরাপদ। ১২ মাসের কম বয়সী শিশুদের মুখে মুখে খাওয়ার সময় মধু সম্ভবত অনিরাপদ। ১২ মাসের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে মধু ব্যবহার করা উচিত না। এই বয়সে বোটুলিজমের বিষক্রিয়া ঘটতে পারে।’বোটুলিজম ‘ ক্লোস্ট্রিডিয়াম বোটুলিনাম স্পোরগুলির সংস্পর্শে আসার কারণে ঘটে। স্পোর থেকে ব্যাকটেরিয়া একটি শিশুর অন্ত্রে বৃদ্ধি এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে, একটি বিপজ্জনক টক্সিন তৈরি করে।
এছাড়াও অতিরিক্ত মধু আমাদের দেহে প্রদাহ, ওজন বৃদ্ধি, হৃদরোগ, লিভারের সমস্যার কারণ হয়ে দাড়াতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, মধুর অপকারিতা অপেক্ষা উপকারিতার পাল্লাই ভারী। নিয়মিত ও পরিমিত পরিমান মধু গ্রহন আমাদের সুস্বাস্থ্য গঠনে সহায়ক।অন্য দিকে অতিরিক্ত মধু আমাদের জন্য বয়ে আনতে পারে ক্ষতি। তাই আমাদের উচিত পরিমিত পরিমানে মধু খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং আমাদের সুস্বাস্থ্যের পথ সুগম করে তোলা।